Unordered List

Definition List

চাকরির বয়সসীমা: ‘ যুক্তির চেয়ে আবেগ জয়যুক্ত হইল’

 

চাকরির বয়সসীমা: ‘ যুক্তির চেয়ে আবেগ জয়যুক্ত হইল’

সরকারি চাকরিতে প্রবেশের বয়সসীমা নিয়ে সাম্প্রতিক বিতর্ক আবারও আলোচনার কেন্দ্রে চলে এসেছে, বিশেষ করে অন্তর্বর্তী সরকারের বয়স বিবেচনা কমিটির সুপারিশের প্রেক্ষিতে। সাবেক সচিব মুয়ীদ চৌধুরীর নেতৃত্বে গঠিত এই কমিটি সম্প্রতি সরকারি চাকরিতে প্রবেশের সর্বোচ্চ বয়স পুরুষদের জন্য ৩৫ এবং নারীদের জন্য ৩৭ বছর করার সুপারিশ করেছে। এ সিদ্ধান্তকে কেন্দ্র করে দেশের বিভিন্ন মহলে মিশ্র প্রতিক্রিয়া দেখা দিয়েছে, যেখানে অনেকেই যুক্তির চেয়ে আবেগকেই বেশি গুরুত্ব দেওয়া হয়েছে বলে মনে করছেন।

https://decorationmercifulmonth.com/f5jwxtrx5?key=bc8601cfdcbeb99476adc484a116647b


বয়সসীমা বাড়ানোর প্রেক্ষাপট

সম্প্রতি সরকারি চাকরিতে প্রবেশের বয়সসীমা বাড়ানোর জন্য আন্দোলনকারী সংগঠনগুলো বেশ সক্রিয় ছিল। তারা ৩২ বছরের ঊর্ধ্বে চাকরিতে প্রবেশের সুযোগ প্রদানের জন্য সরকারের কাছে দাবি জানিয়ে আসছিল। বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ের সেশনজট, কোভিড-১৯ মহামারির কারণে শিক্ষার্থীদের শিক্ষাজীবন বিলম্বিত হওয়া, এবং অন্যান্য সামাজিক ও অর্থনৈতিক কারণে চাকরিতে প্রবেশের বয়সসীমা বাড়ানোর দাবিটি ক্রমশ জোরালো হয়ে ওঠে। অবশেষে সরকারের ওপর আন্দোলনের চাপ তৈরি হয় এবং সরকার বয়স বিবেচনা কমিটি গঠন করে, যা দ্রুত সিদ্ধান্ত গ্রহণ করে সুপারিশমালা প্রদান করে।

যুক্তি বনাম আবেগ

বয়সসীমা বাড়ানোর পক্ষে প্রধান যুক্তি ছিল সেশনজট এবং মহামারি। বিশেষ করে সেশনজট বাংলাদেশের শিক্ষা ব্যবস্থায় একটি দীর্ঘমেয়াদি সমস্যা। শিক্ষার্থীরা সময়মতো পড়াশোনা শেষ করতে না পারায় তাদের কর্মজীবনে প্রবেশ করতে বিলম্ব হয়। মহামারি পরিস্থিতি এই সমস্যাকে আরও জটিল করে তুলেছে। তবে অনেকেই প্রশ্ন তুলছেন, দীর্ঘমেয়াদি সেশনজট কেন সরকারি সিদ্ধান্তের মূল কারণ হয়ে উঠল, যখন এর মোকাবিলায় কার্যকর পদক্ষেপ নেওয়া উচিত ছিল। অতীতে শিক্ষার্থীরা সেশনজটের বিরুদ্ধে সোচ্চার ছিল, কিন্তু এখন চাকরির বয়স বাড়ানোর মাধ্যমে সেই সমস্যার মোকাবিলা না করে বরং তাকে স্বাভাবিক হিসেবে গ্রহণ করা হচ্ছে বলে অনেকে মনে করছেন।

নারীদের জন্য অতিরিক্ত সুযোগ

বয়স বিবেচনা কমিটি পুরুষদের জন্য সর্বোচ্চ বয়স ৩৫ এবং নারীদের জন্য ৩৭ বছর করার সুপারিশ করেছে। এই সিদ্ধান্ত নারীবান্ধবতার প্রমাণ হিসেবে উল্লেখ করা হয়েছে, যার মাধ্যমে নারীরা বেশি সুযোগ পাবেন বলে আশা করা হচ্ছে। তবে অনেকেই এই সিদ্ধান্তের যৌক্তিকতা নিয়ে প্রশ্ন তুলেছেন। নারীদের জন্য অতিরিক্ত বয়সসীমার সুবিধা কেন প্রয়োজন, তা নিয়ে সামাজিক মাধ্যমে নানা প্রশ্ন উঠেছে। কমিটির প্রধান মুয়ীদ চৌধুরী এই সিদ্ধান্তের পেছনে যুক্তি হিসেবে উল্লেখ করেছেন যে, নারীদের পারিবারিক দায়িত্ব এবং অন্যান্য সামাজিক বাধ্যবাধকতা থাকে, যার কারণে তারা পুরুষদের মতো পরীক্ষা দিতে পারেন না। তবে অনেকে মনে করেন, এটি একটি সাধারণীকৃত ধারণা, যা নারীদের দক্ষতা এবং সামর্থ্যকে খাটো করে দেখে। নারীদের জন্য শিক্ষাক্ষেত্রে আরও বেশি সহায়ক পরিবেশ তৈরির পরিবর্তে কেবল বয়সসীমা বাড়িয়ে তাদের প্রশাসনে নিয়ে আসার পরিকল্পনা খুব একটা কার্যকর হবে না। যোগ্য নারীদের চাকরিতে আনার জন্য গোড়ায় থেকেই পদক্ষেপ নিতে হবে, যাতে তারা নির্বিঘ্নে পড়াশোনা চালিয়ে যেতে পারেন।

কম বয়সী চাকরিপ্রার্থীদের দক্ষতা

বয়সসীমা বাড়ানোর বিরোধীরা যুক্তি দিয়েছেন যে, তরুণ বয়সেই কর্মক্ষেত্রে প্রবেশ করা বেশি ফলপ্রসূ। সাবেক মন্ত্রিপরিষদ সচিব আলী ইমাম মজুমদার ২০১৮ সালে বিবিসিকে দেওয়া এক সাক্ষাৎকারে উল্লেখ করেছিলেন যে, ৩৫ বছর বয়সে সরকারি চাকরিতে প্রবেশ করলে তরুণদের মেধা ও দক্ষতা পুরোপুরি কাজে লাগানো সম্ভব হবে না। একই ধরনের মতামত বর্তমান সিনিয়র সচিব আবু আলম মোহাম্মদ শহীদ খানও প্রকাশ করেছেন। তাদের মতে, সরকার ২৪-২৫ বছর বয়সের একজন তরুণকে যথাযথ প্রশিক্ষণ দিয়ে দক্ষ কর্মী হিসেবে গড়ে তুলতে পারে, যা বয়স বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে কম কার্যকর হতে থাকে। বয়স বাড়লে ব্যক্তির অভিজ্ঞতা বাড়লেও, বিভিন্ন প্রতিযোগিতামূলক পরীক্ষায় ভালো করার সম্ভাবনা হ্রাস পায়।

বিসিএস পরীক্ষার পরিসংখ্যানও এই দাবির পক্ষে কথা বলে। ৪৩তম বিসিএসের চূড়ান্ত ফলাফল বিশ্লেষণ করে দেখা গেছে, ২৯ বছরের বেশি বয়সীদের মধ্যে মাত্র ১.৭১ শতাংশ উত্তীর্ণ হয়েছেন। ৪১তম বিসিএসে এই হার ছিল ১.৬৭ শতাংশ, এবং ৩৮তম বিসিএসে ২.৪১৪ শতাংশ। এই পরিসংখ্যান থেকে বোঝা যায় যে, তুলনামূলকভাবে কম বয়সীরা এ ধরনের পরীক্ষায় বেশি ভালো করে থাকেন।

ভবিষ্যতের চ্যালেঞ্জ

চাকরির বয়সসীমা বাড়ানোর দাবিটি মেনে নেওয়া হলেও, প্রশাসনিক কর্মকর্তাদের সংগঠন ‘অ্যাডমিনিস্ট্রেটিভ সার্ভিস অ্যাসোসিয়েশন’ আরও দাবি জানিয়েছে। তারা চাকরিতে প্রবেশের বয়সসীমা ৩৫ এবং অবসরের বয়স ৬৫ করার দাবি করেছে। এই দাবিগুলো যদি পরবর্তীতে আরও বড় আন্দোলনে রূপ নেয়, তাহলে অন্তর্বর্তী সরকারের জন্য পরিস্থিতি আরও জটিল হয়ে উঠতে পারে।

বয়স বিবেচনা কমিটির সুপারিশের সমর্থকরা দাবি করেছেন যে, বর্তমান সরকার তাদের আবেগকে মূল্যায়ন করেছে। তবে অনেকেই মনে করছেন, যুক্তির চেয়ে আবেগকেই বেশি গুরুত্ব দেওয়া হয়েছে। সেশনজট সমস্যার মূল কারণ হিসেবে নির্ধারণ করা এবং নারীদের জন্য বয়সসীমা বাড়ানোর বিষয়গুলো আরও গভীরভাবে পর্যালোচনা করা উচিত ছিল। যুক্তিসঙ্গত প্রমাণ ও বাস্তবিক পরিসংখ্যানের ভিত্তিতে সঠিক সিদ্ধান্ত গ্রহণের বদলে আবেগপ্রসূত সিদ্ধান্ত নেওয়া হলে তার দীর্ঘমেয়াদি প্রভাব নেতিবাচক হতে পারে।

উপসংহার

সরকারি চাকরিতে প্রবেশের বয়সসীমা বৃদ্ধি একটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয়, যা দেশের তরুণ প্রজন্মের জন্য বড় প্রভাব ফেলতে পারে। তবে শুধু বয়স বাড়ানোর মাধ্যমে সমস্যার সমাধান হবে না। শিক্ষা ব্যবস্থায় সেশনজট, নারীদের শিক্ষাক্ষেত্রে অব্যাহত বাধা এবং অন্যান্য কাঠামোগত সমস্যাগুলো মোকাবিলার জন্য কার্যকর পদক্ষেপ নিতে হবে। দক্ষ ও যোগ্য প্রার্থীদের চাকরিতে আনতে হলে শিক্ষাব্যবস্থা ও নিয়োগ প্রক্রিয়ায় আরও স্বচ্ছতা ও দক্ষতার প্রয়োজন।

No comments:

Powered by Blogger.