সহিংসতা বিক্ষোভকারীদের ওপর হোক বা বিক্ষোভকারীরা করুক, জবাবদিহির আওতায় আনতে হবে: যুক্তরাষ্ট্র
যুক্তরাষ্ট্র সম্প্রতি বাংলাদেশের রাজনৈতিক সহিংসতার বিষয়ে তাদের অবস্থান স্পষ্ট করেছে এবং বলেছে যে সহিংসতা যেখান থেকেই আসুক না কেন, তার জবাবদিহি নিশ্চিত করতে হবে। মার্কিন পররাষ্ট্র দপ্তরের মুখপাত্র ম্যাথু মিলার ১৬ অক্টোবর ২০২৪ তারিখে নিয়মিত সংবাদ ব্রিফিংয়ে এক প্রশ্নের জবাবে বলেন, সহিংসতার জন্য কেউ দায়ী হলে তাকে অবশ্যই জবাবদিহির আওতায় আনা হবে, তা সে বিক্ষোভকারীদের ওপর সহিংসতা হোক বা বিক্ষোভকারীরা নিজেরাই সহিংসতায় লিপ্ত থাকুক। এই মন্তব্য বাংলাদেশের চলমান রাজনৈতিক পরিস্থিতি এবং সাম্প্রতিক গণ-অভ্যুত্থানের প্রেক্ষাপটে গুরুত্বপূর্ণ বলে বিবেচিত হচ্ছে।
বাংলাদেশের সাম্প্রতিক রাজনৈতিক প্রেক্ষাপট
বাংলাদেশের সাম্প্রতিক রাজনৈতিক পরিস্থিতি ক্রমশ উত্তপ্ত হয়ে উঠছে। শেখ হাসিনা সরকারের বিরুদ্ধে ব্যাপক আন্দোলন চলছে, যেখানে ছাত্র-জনতা এবং বিরোধী দলগুলো সক্রিয়ভাবে অংশগ্রহণ করছে। ২০২৪ সালের আগস্টে ছাত্র-জনতার নেতৃত্বে এক গণ-অভ্যুত্থানের ফলে শেখ হাসিনার সরকার পতন হয়। এই অভ্যুত্থানকে কেন্দ্র করে দেশের বিভিন্ন স্থানে ব্যাপক সহিংসতা ঘটে। বিভিন্ন প্রতিবেদন অনুযায়ী, এই সহিংসতার সময় তিন হাজারেরও বেশি পুলিশ সদস্য নিহত হন এবং ৪০০-এর বেশি থানায় আক্রমণ হয়। আওয়ামী লীগের অনেক নেতা-কর্মীও বিক্ষোভকারীদের হামলার শিকার হন।
ড. মুহাম্মদ ইউনূস এই পরিস্থিতিকে "সমন্বিত পরিকল্পনা" হিসেবে উল্লেখ করেন। তাঁর বক্তব্যে এই ধারণা উঠে আসে যে, বিক্ষোভকারীরা একটি সুপরিকল্পিত কাঠামোর মধ্যে থেকে আন্দোলন পরিচালনা করছে। ফলে সহিংসতার দায় কার ওপর বর্তায়, সে প্রশ্নও সামনে আসে। মার্কিন পররাষ্ট্র দপ্তর এই পরিস্থিতি নিবিড়ভাবে পর্যবেক্ষণ করছে এবং সহিংসতার পক্ষে কোনো অজুহাতের সুযোগ নেই বলে তাদের অবস্থান স্পষ্ট করেছে।
সহিংসতার জবাবদিহি: মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের আহ্বান
মার্কিন পররাষ্ট্র দপ্তরের মুখপাত্র ম্যাথু মিলার বলেন, যুক্তরাষ্ট্র সহিংসতার বিরুদ্ধে এবং যারা সহিংসতার জন্য দায়ী, তাদের অবশ্যই জবাবদিহির আওতায় আনতে হবে। তাঁর বক্তব্যে আরও উল্লেখ করা হয় যে, যুক্তরাষ্ট্র বাংলাদেশের সরকারকে আহ্বান জানাবে যাতে রাজনৈতিক পরিচয়নির্বিশেষে সব ভুক্তভোগী ন্যায়বিচার পায়। এটি বিশেষভাবে গুরুত্বপূর্ণ কারণ বাংলাদেশে সহিংসতার শিকার ব্যক্তি শুধু নির্দিষ্ট রাজনৈতিক দল বা গোষ্ঠীর মধ্যে সীমাবদ্ধ নয়, বরং দেশের বিভিন্ন শ্রেণি-পেশার মানুষ এতে আক্রান্ত হয়েছে।
এখানে উল্লেখ করা প্রয়োজন, যুক্তরাষ্ট্র আগেও বিভিন্ন দেশের অভ্যন্তরীণ রাজনৈতিক সংঘর্ষের বিষয়ে এ ধরনের অবস্থান নিয়েছে। তারা সহিংসতার ন্যায্যতা প্রদান করে না, বরং এর নেপথ্যে থাকা কারণগুলি খতিয়ে দেখার আহ্বান জানায় এবং আন্তর্জাতিক মানবাধিকার ও ন্যায়বিচার প্রতিষ্ঠার পক্ষে তাদের অবস্থান জোরালো করে। বাংলাদেশে চলমান পরিস্থিতির মধ্যে এটি অত্যন্ত তাৎপর্যপূর্ণ।
৫ থেকে ৮ আগস্টের সহিংসতা এবং স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের প্রতিক্রিয়া
মার্কিন সংবাদ ব্রিফিংয়ের এক সাংবাদিক বলেন, শেখ হাসিনা দেশ ছেড়ে চলে যাওয়ার পর ৫ থেকে ৮ আগস্ট পর্যন্ত সময়ে সংঘটিত সহিংসতার ঘটনায় বাংলাদেশের স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয় তদন্ত ও বিচার প্রক্রিয়াকে স্থগিত করেছে। প্রতিবেদনে জানা যায়, পুলিশের ওপর ব্যাপক আক্রমণ এবং থানা গুঁড়িয়ে দেওয়া হয়। একইসঙ্গে আওয়ামী লীগের অনেক সদস্য সহিংসতার শিকার হন। তবে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয় থেকে জানানো হয়, আন্দোলনকারীদের বিরুদ্ধে ১৫ জুলাই থেকে ৮ আগস্ট পর্যন্ত সংঘটিত ঘটনাসংশ্লিষ্ট কোনো মামলা, গ্রেপ্তার বা হয়রানি করা হবে না। এ সিদ্ধান্ত একটি নতুন রাজনৈতিক সমীকরণের অংশ হিসেবে দেখা হচ্ছে, যেখানে অন্তর্বর্তীকালীন সরকার বিভিন্ন পক্ষকে নিয়ে ঐক্যবদ্ধভাবে কাজ করতে চাচ্ছে।
ধর্মীয় স্বাধীনতা ও হিন্দু সম্প্রদায়ের ওপর আক্রমণ
সংবাদ ব্রিফিংয়ের সময় চট্টগ্রামে দুর্গাপূজার মণ্ডপে ইসলামি গান পরিবেশন নিয়ে একটি প্রশ্ন করা হয়। এই ঘটনা বাংলাদেশে ধর্মীয় সম্প্রদায়ের মধ্যে উত্তেজনা তৈরি করেছে। হিন্দু সম্প্রদায় বাংলাদেশের অন্যতম সংখ্যালঘু গোষ্ঠী, এবং এ ধরনের ঘটনা সংখ্যালঘুদের ধর্মীয় অধিকার লঙ্ঘনের উদাহরণ হিসেবে বিবেচিত হয়েছে।
ম্যাথু মিলার এই প্রসঙ্গে বলেন, যুক্তরাষ্ট্র সব দেশেই ধর্মীয় স্বাধীনতা রক্ষার বিষয়ে প্রতিশ্রুতিবদ্ধ এবং এই বিষয়ে আরও তথ্য সংগ্রহ করে পরে মন্তব্য করবেন। বাংলাদেশের ধর্মীয় সম্প্রদায়ের ওপর আক্রমণ নিয়ে যুক্তরাষ্ট্র এর আগেও উদ্বেগ প্রকাশ করেছে, বিশেষ করে যখন সংখ্যালঘুদের ওপর আক্রমণ ঘটে।
মার্কিন প্রশাসনের অবস্থান: নিরপেক্ষতা ও মানবাধিকারের পক্ষে
মার্কিন পররাষ্ট্র দপ্তরের এই বক্তব্য স্পষ্ট করে যে, তারা সহিংসতার পক্ষে কোনো অবস্থান নিতে চায় না। যুক্তরাষ্ট্র বরাবরই মানবাধিকার রক্ষার পক্ষে জোরালো অবস্থান নিয়ে এসেছে এবং এই ধরনের সংঘর্ষমূলক পরিস্থিতিতে তারা পক্ষপাতমূলক অবস্থান না নিয়ে সর্বদা ন্যায়বিচার প্রতিষ্ঠার আহ্বান জানায়। বাংলাদেশের ক্ষেত্রে, রাজনৈতিক অস্থিরতার সময়ে যুক্তরাষ্ট্র এ ধরনের আহ্বান জানিয়েছে যাতে দেশের জনগণের মৌলিক অধিকারগুলো সুরক্ষিত থাকে।
এদিকে, বাংলাদেশে সহিংসতা, ধর্মীয় উত্তেজনা এবং রাজনৈতিক সংকট বৃদ্ধি পাওয়ায় আন্তর্জাতিক মহলও গভীরভাবে উদ্বিগ্ন। আন্তর্জাতিক মানবাধিকার সংগঠনগুলোও বাংলাদেশের পরিস্থিতি নিয়ে উদ্বেগ প্রকাশ করেছে এবং সহিংসতা বন্ধে কার্যকর পদক্ষেপ নেওয়ার আহ্বান জানিয়েছে। বাংলাদেশের রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্যে ঐক্য ও সংলাপের মাধ্যমে একটি স্থায়ী সমাধানের জন্য আন্তর্জাতিক মহলের চাপও বাড়ছে।
ভবিষ্যত দৃষ্টিভঙ্গি
বাংলাদেশের রাজনৈতিক অস্থিরতা এবং সহিংসতা মোকাবিলার জন্য আন্তর্জাতিক চাপ বাড়তে পারে। যুক্তরাষ্ট্রের সাম্প্রতিক বিবৃতিতে স্পষ্ট করা হয়েছে যে, তারা সহিংসতার পক্ষে কোনো অজুহাত দাঁড় করাতে চায় না এবং সব পক্ষকেই জবাবদিহির আওতায় আনতে চায়।
এই পরিস্থিতিতে, বাংলাদেশের রাজনৈতিক দলগুলোর জন্য একটি গুরুত্বপূর্ণ চ্যালেঞ্জ হলো সহিংসতা রোধ করা এবং স্থিতিশীল রাজনৈতিক পরিবেশ নিশ্চিত করা। একইসঙ্গে, সংখ্যালঘুদের অধিকার এবং ধর্মীয় স্বাধীনতা রক্ষা করাও গুরুত্বপূর্ণ। আন্তর্জাতিক মহলের এ ধরনের নজরদারি বাংলাদেশের রাজনৈতিক নেতাদেরকে একটি স্থায়ী সমাধানের দিকে ধাবিত করতে পারে।
No comments: