Unordered List

Definition List

আনুপাতিক প্রতিনিধিত্বে স্বৈরশাসকের ফেরা সহজ

 

আনুপাতিক প্রতিনিধিত্বে স্বৈরশাসকের ফেরা সহজ

কামাল আহমেদের লেখা "আনুপাতিক প্রতিনিধিত্বে স্বৈরশাসকের ফেরা সহজ" শীর্ষক প্রবন্ধটি বাংলাদেশের রাজনৈতিক প্রেক্ষাপটে আনুপাতিক প্রতিনিধিত্ব (Proportional Representation) নির্বাচনী পদ্ধতির প্রভাব ও তার সম্ভাব্য নেতিবাচক ফলাফল নিয়ে বিশদ আলোচনা করে। তিনি তুলে ধরেছেন যে, বাংলাদেশে আনুপাতিক প্রতিনিধিত্ব প্রবর্তন করা হলে তা কীভাবে ক্ষমতাসীন দল এবং বিশেষ করে স্বৈরশাসকদের জন্য সুবিধাজনক হতে পারে।



গণতন্ত্র থেকে বিচ্যুতি এবং স্বৈরতন্ত্রের উত্থান

বাংলাদেশের সাম্প্রতিক রাজনৈতিক ইতিহাসকে বিশ্লেষণ করতে গিয়ে কামাল আহমেদ উল্লেখ করেছেন, এরশাদের সামরিক স্বৈরাচারের পতনের পর গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠার জন্য নির্বাচনব্যবস্থার উপর ভরসা করা হয়েছিল। তবে দুটি প্রধান রাজনৈতিক দল, আওয়ামী লীগ এবং বিএনপি, ক্রমান্বয়ে নির্বাচনকে গণতন্ত্রের চর্চা থেকে বিচ্যুত করে ক্ষমতা দখলের হাতিয়ারে পরিণত করেছে। বিশেষ করে, আওয়ামী লীগ শেখ হাসিনার নেতৃত্বে ক্ষমতায় এসে নির্বাচন প্রক্রিয়াকে একটি প্রহসনে পরিণত করেছে বলে লেখক দাবি করেন। এর ফলে জনগণের ভোটের অধিকার হরণ এবং নির্বাচনী প্রক্রিয়া বিকৃত হয়েছে।

আনুপাতিক প্রতিনিধিত্বের ধারণা

লেখক উল্লেখ করেছেন, বর্তমান সংকটের সমাধান হিসেবে আনুপাতিক প্রতিনিধিত্বকে একটি বিকল্প পদ্ধতি হিসেবে বিবেচনা করা হচ্ছে। আনুপাতিক প্রতিনিধিত্ব পদ্ধতিতে একটি দল যত শতাংশ ভোট পাবে, সে অনুপাতে তারা সংসদে আসন পাবে। অর্থাৎ, জনগণের ভোটের ভিত্তিতে আসন বণ্টন করা হবে। এই ব্যবস্থার মাধ্যমে ছোট দলগুলোকেও রাজনৈতিক পরিসরে অংশগ্রহণের সুযোগ দেওয়া হয়, যা বহুদলীয় গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠায় সহায়ক হতে পারে বলে অনেকেই মনে করেন।

তবে কামাল আহমেদ মনে করেন, আনুপাতিক প্রতিনিধিত্ব পদ্ধতিকে একমাত্র বা চূড়ান্ত সমাধান হিসেবে বিবেচনা করা ভুল হবে। কারণ, এ ধরনের ব্যবস্থা রাজনীতির গুণগত পরিবর্তন আনতে পারবে না যদি রাজনৈতিক দলগুলোর অভ্যন্তরীণ সংস্কার না হয়। তিনি আরও উল্লেখ করেছেন যে, এই পদ্ধতি প্রবর্তনের মাধ্যমে গণতান্ত্রিক শাসনব্যবস্থায় বাস্তবিক পরিবর্তন আনা সম্ভব নয় যদি রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্যে সুশাসনের অভাব থাকে।

স্বৈরশাসকের প্রত্যাবর্তনের আশঙ্কা

আনুপাতিক প্রতিনিধিত্বের সবচেয়ে বড় সমস্যা হিসেবে কামাল আহমেদ দেখিয়েছেন, এটি স্বৈরশাসকদের জন্য ক্ষমতায় ফিরে আসার একটি সুযোগ তৈরি করতে পারে। তিনি ব্যাখ্যা করেছেন যে, এই ব্যবস্থায় একটি দলের জন্য সংসদে নিরঙ্কুশ সংখ্যাগরিষ্ঠতা পাওয়া কঠিন। ফলে কোনো দল এককভাবে সংবিধান সংশোধন করতে পারবে না, যা স্বৈরশাসন প্রতিষ্ঠার একটি বড় প্রতিবন্ধক। তবে এ ধরনের পরিস্থিতিতে ছোট দলগুলোর সঙ্গে জোট গঠনের মাধ্যমে স্বৈরশাসকরা আবার ক্ষমতায় ফিরে আসতে পারে।

শেখ হাসিনার নেতৃত্বাধীন আওয়ামী লীগের ক্ষেত্রে কামাল আহমেদ মনে করেন, আনুপাতিক প্রতিনিধিত্ব পদ্ধতিতে নির্বাচন হলে তাদের পক্ষে রাজনীতিতে ফিরে আসার পথ সুগম হবে। কারণ, ভোটের শতাংশের ভিত্তিতে আওয়ামী লীগ সংসদে কিছু আসন পেতে পারে, যা বিদ্যমান পদ্ধতিতে সম্ভব নাও হতে পারে। তিনি আরও বলেন, এ পদ্ধতির মাধ্যমে আওয়ামী লীগ যেমন সুবিধা পেতে পারে, তেমনই অন্যান্য ছোট দলগুলোও এর সুযোগ নিতে পারে, বিশেষ করে জামায়াতে ইসলামী। এ কারণেই জামায়াত এই পদ্ধতির পক্ষে সোচ্চার হয়ে উঠেছে।

অন্যান্য দেশে আনুপাতিক প্রতিনিধিত্বের প্রভাব

আন্তর্জাতিক প্রেক্ষাপটে আনুপাতিক প্রতিনিধিত্বের প্রভাব নিয়ে আলোচনা করতে গিয়ে কামাল আহমেদ যুক্তরাজ্যের উদাহরণ দিয়েছেন। যুক্তরাজ্যে ইউরোপীয় পার্লামেন্টের নির্বাচনে আনুপাতিক প্রতিনিধিত্ব ব্যবস্থার কারণে উগ্র ডানপন্থী অভিবাসনবিরোধী রাজনীতিক নাইজেল ফারাজের মতো নেতারা রাজনৈতিকভাবে গুরুত্বপূর্ণ হয়ে উঠেছেন। ইউরোপীয় পার্লামেন্টে নির্বাচিত হয়ে নাইজেল ফারাজ ইউরোপীয় ইউনিয়নবিরোধী রাজনীতি করেছেন এবং যুক্তরাজ্যের ব্রেক্সিট আন্দোলনের নেতৃস্থানীয় ভূমিকা পালন করেছেন।

এই উদাহরণ থেকে লেখক ইঙ্গিত দেন যে, আনুপাতিক প্রতিনিধিত্ব পদ্ধতি উগ্রবাদী বা জনতুষ্টিবাদী রাজনীতির উত্থান ঘটাতে পারে, যা গণতান্ত্রিক শাসনব্যবস্থার জন্য ক্ষতিকর হতে পারে।

বাংলাদেশে আনুপাতিক প্রতিনিধিত্বের রাজনৈতিক প্রেক্ষাপট

বাংলাদেশের প্রেক্ষাপটে আনুপাতিক প্রতিনিধিত্বের প্রস্তাব নিয়ে আলোচনা করতে গিয়ে কামাল আহমেদ উল্লেখ করেছেন যে, একাধিক ছোট দল এই পদ্ধতি প্রবর্তনের পক্ষে কথা বলছে। ২০১৭ সালে নিবন্ধিত রাজনৈতিক দলগুলোর সঙ্গে নির্বাচন কমিশনের আলোচনায় জাতীয় পার্টি, সিপিবি, ইসলামী আন্দোলন বাংলাদেশ, বাংলাদেশ ন্যাশনাল আওয়ামী পার্টি, বিপ্লবী ওয়ার্কার্স পার্টি, বাসদ প্রভৃতি দল আনুপাতিক প্রতিনিধিত্বে নির্বাচনের প্রস্তাব করেছিল। এই দলগুলোর জাতীয় ভোটের হার খুব কম হলেও আনুপাতিক প্রতিনিধিত্বের মাধ্যমে তারা সংসদে আসন পাওয়ার সুযোগ সৃষ্টি করতে পারে। তবে লেখক মনে করেন, এ ধরনের প্রান্তিক দলগুলোর রাজনৈতিক ভূমিকা খুবই সীমিত এবং তাদের আনুপাতিক প্রতিনিধিত্বে বিশেষ কোনো উন্নতি হওয়ার সম্ভাবনা নেই।

সংবিধান সংশোধন ও দ্বিকক্ষবিশিষ্ট পার্লামেন্ট

লেখক মনে করেন, যদি বাংলাদেশে সংবিধান সংশোধন করে দ্বিকক্ষবিশিষ্ট পার্লামেন্ট গঠন করা হয়, তবে আনুপাতিক প্রতিনিধিত্ব ব্যবস্থার কার্যকর ব্যবহার সম্ভব হতে পারে। বিশেষ করে উচ্চকক্ষে বিভিন্ন শ্রেণি-পেশার প্রতিনিধিত্বের জন্য আনুপাতিক ব্যবস্থাকে কার্যকরভাবে ব্যবহার করা যেতে পারে। এতে রাজনৈতিক অন্তর্ভুক্তি বাড়ানোর পাশাপাশি বিভিন্ন দল ও গোষ্ঠীর সুষ্ঠু প্রতিনিধিত্ব নিশ্চিত করা সম্ভব হতে পারে।

উপসংহার

কামাল আহমেদের এই প্রবন্ধ থেকে স্পষ্ট হয় যে, আনুপাতিক প্রতিনিধিত্ব পদ্ধতির পক্ষে যেমন কিছু যুক্তি রয়েছে, তেমনি এর বিরুদ্ধেও কিছু গুরুত্বপূর্ণ বিপদ রয়েছে। তিনি মনে করেন, এই পদ্ধতি প্রবর্তন করলে স্বৈরশাসক এবং ক্ষমতালোভী দলগুলোর জন্য রাজনীতিতে ফিরে আসার সুযোগ তৈরি হতে পারে। এছাড়া, রাজনীতিতে গুণগত পরিবর্তন আনতে হলে শুধু নির্বাচনব্যবস্থার পরিবর্তন নয়, রাজনৈতিক দলগুলোর অভ্যন্তরীণ সংস্কারও জরুরি।

No comments:

Powered by Blogger.