আয়নাঘরের দুঃস্বপ্নের সেই সব দিন
শেখ হাসিনা সরকারের পতনের পর বাংলাদেশে ছাত্র-জনতার অভ্যুত্থান একটি নতুন ইতিহাসের সূচনা করলেও একই সঙ্গে প্রকাশ্যে আসে আয়নাঘরের নিষ্ঠুরতার গল্প। শেখ হাসিনার শাসনামলে গোপন এই বন্দিশালায় ভিন্নমতাবলম্বী, রাজনৈতিক প্রতিপক্ষ ও সাধারণ নাগরিকদের ওপর চালানো হয় অমানবিক নির্যাতন। আয়নাঘর থেকে মুক্তিপ্রাপ্ত কয়েকজনের সাক্ষাৎকারে উঠে আসে এ বন্দিশালার নৃশংস চিত্র, যা নিয়ে ১৭ অক্টোবর ২০২৪ সালে দ্য নিউইয়র্ক টাইমস একটি প্রতিবেদন প্রকাশ করে।
আয়নাঘর: নিপীড়নের কেন্দ্র
আয়নাঘর, শেখ হাসিনার শাসনামলে পরিচালিত একটি গোপন কারাগার, যেখানে বন্দীদের মানসিক ও শারীরিকভাবে নির্যাতন করা হতো। অনেক রাজনৈতিক কর্মী, মানবাধিকারকর্মী, আইনজীবী, সাংবাদিক, এবং সাধারণ নাগরিক যারা সরকারের সমালোচনা করতেন বা রাজনৈতিকভাবে ভিন্নমত পোষণ করতেন, তাঁরা এখানে আটক থাকতেন। নিউইয়র্ক টাইমস-এর প্রতিবেদনে উঠে এসেছে, এই বন্দিশালার ভুক্তভোগীরা ছিলেন ক্ষমতাসীন সরকারের প্রতিহিংসার শিকার।
বন্দীদের ওপর চালানো অমানবিক নির্যাতনের ফলে অনেকেই মানসিক ভারসাম্য হারান। কেউ কেউ আয়নাঘরেই মারা যান, আর কেউ বের হওয়ার পর সমাজে ফিরে স্বাভাবিক জীবনে ফিরে আসতে পারেননি। এই নির্যাতনের ভয়াবহ চিত্র প্রকাশের পর, মুক্তিপ্রাপ্তদের কণ্ঠে উঠে এসেছে শেখ হাসিনার শাসনামলের বিভীষিকার কথা।
বন্দী জীবন: একটি ভয়ানক অধ্যায়
প্রতিবেদনে আয়নাঘর থেকে মুক্তি পাওয়া মীর আহমেদ কাসেম আরমান-এর সাক্ষাৎকার উল্লেখ করা হয়। তিনি ছিলেন একজন সুপ্রিম কোর্টের আইনজীবী এবং মীর কাসেম আলীর ছেলে, যিনি মানবতাবিরোধী অপরাধের দায়ে মৃত্যুদণ্ডপ্রাপ্ত। তাঁকে কোনও অপরাধে অভিযুক্ত না হয়েও আট বছর ধরে আয়নাঘরে আটক রাখা হয়েছিল।
আরমান তাঁর বন্দী জীবনের স্মৃতিচারণ করতে গিয়ে বলেন, "আমি সব সময় স্রষ্টার কাছে প্রার্থনা করেছি, এ পৃথিবীতে যদি আমাদের আর দেখা না হয়, তবে বেহেশতে যেন একত্র হতে পারি।" তাঁর এই বক্তব্য আয়নাঘরের কঠিন জীবনযাত্রার একটা প্রাথমিক চিত্র তুলে ধরে।
অন্যদিকে, সাবেক উচ্চপদস্থ সেনা কর্মকর্তা আবদুল্লাহিল আমান আজমি-র কথাও প্রতিবেদনে এসেছে। আমান আজমি ছিলেন বাংলাদেশ জামায়াতে ইসলামীর প্রয়াত আমির গোলাম আজমের পুত্র। তিনিও আট বছর ধরে আয়নাঘরে বন্দী ছিলেন। তাঁর অভিযোগ, তাঁকে ৪১ হাজারবার হাতকড়া পরানো হয় এবং চোখ বাঁধা হয়।
তিনি জানান, বন্দী অবস্থায় তিনি কখনো আকাশ, সূর্য বা প্রকৃতির কোনো দৃশ্য দেখতে পাননি। কারাগারে ছিল না কোনো জীবনযাপনের উপযুক্ত পরিবেশ। নিয়মিত শারীরিক পরীক্ষা-নিরীক্ষার পাশাপাশি চলত মানসিক নির্যাতন।
গুম এবং বিচারহীনতার সংস্কৃতি
প্রতিবেদনে আরও উল্লেখ করা হয়, শেখ হাসিনার শাসনামলে গুমের ঘটনা ছিল অত্যন্ত সাধারণ। মানবাধিকার সংস্থাগুলোর তথ্য অনুযায়ী, ২০০৯ থেকে ২০২১ সালের মধ্যে ৬০৫ জন মানুষ গুম হয়েছেন। তাঁদের অনেককে বিক্ষোভে অংশগ্রহণের দায়ে অথবা সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে সমালোচনা করার জন্য গুম করা হয়। অনেকের কোনো খোঁজ পাওয়া যায়নি। আবার অনেকেই গুমের পর বন্দিশালায় বছরের পর বছর আটক থাকেন। ভুক্তভোগীদের বেশিরভাগকেই ফেলে দেওয়া হয় এই গোপন বন্দিশালার অন্ধকার কক্ষে, যেখানে মানসিক ও শারীরিক অত্যাচার ছিল নিত্যনৈমিত্তিক ব্যাপার।
তাসনিম শিপরা, যিনি তাঁর চাচাকে ২০১৩ সালে হারিয়েছেন, প্রতিবেদনে বলেন, "আমরা জানতে চাই কী ঘটেছে।" শিপরার চাচা বেলাল হোসেন নিখোঁজ হওয়ার পর তাঁকে আর খুঁজে পাওয়া যায়নি। এ ধরনের গুমের ঘটনায় ভুক্তভোগী পরিবারগুলো আজও বিচারপ্রার্থীর মতো অপেক্ষায় আছেন।
আঁকা চিত্রে বন্দী জীবন
প্রতিবেদনে আয়নাঘর থেকে মুক্তিপ্রাপ্ত কয়েকজনকে বন্দিশালার একটি স্কেচ আঁকার অনুরোধ করা হয়েছিল। তাঁদের আঁকা চিত্রে দেখা যায়, একটি লম্বা করিডরের দুই পাশে আধা ডজন কক্ষ। প্রতিটি কক্ষ আলাদা হলেও করিডরের দুই প্রান্তে ছিল দুইটি শৌচাগার, একটিতে দাঁড়িয়ে ব্যবহারের ব্যবস্থা এবং অন্যটিতে বসার। প্রতিটি কক্ষে ছিল একটি বড় ফ্যান, যার মাধ্যমে নিরাপত্তারক্ষীদের কথা শোনা যেত না এবং বন্দীদের মানসিকভাবে দুর্বল করে তোলা হতো।
শেখ হাসিনার পতন এবং আয়নাঘরের উন্মোচন
শেখ হাসিনার সরকার পতনের পর আয়নাঘরের নিষ্ঠুরতার ঘটনা বিশ্ব মিডিয়ায় নতুন করে আলোচনার কেন্দ্রে চলে আসে। ২০২৪ সালের ছাত্র-জনতার অভ্যুত্থানের ফলে শেখ হাসিনার দীর্ঘ একনায়কতান্ত্রিক শাসনের অবসান ঘটে। কিন্তু তাঁর শাসনামলের গোপন বন্দিশালা, গুম, এবং মানবাধিকার লঙ্ঘনের যে চিত্র বিশ্ববাসীর সামনে আসে, তা বাংলাদেশের ইতিহাসের একটি কালো অধ্যায় হিসেবে চিহ্নিত হয়ে থাকবে।
প্রতিবেদনটি শেষ হয় এই কথার মাধ্যমে যে, আয়নাঘরের বন্দী হওয়া মানুষেরা হয়তো মুক্তি পেয়েছেন, কিন্তু তাঁদের মানসিক এবং শারীরিক আঘাত কখনো পুরোপুরি নিরাময় করা সম্ভব নয়।
No comments: